রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গুরুতর অসুস্থ হয়ে টানা ১১ দিন ধরে সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধায়নে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া।

তবে ঝুঁকিমুক্ত নন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন খালেদা জিয়া চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছেন বলে। তবে তাঁর শারীরিক অবস্থা এখনো বেশ উদ্বেগজনক পর্যায়েই রয়ে গেছে। বিশেষ করে তাঁর হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি ও ফুসফুসের জটিলতা কাটছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দেখা যাচ্ছে চিকিৎসায় এ সমস্যাগুলোর একটির সামান্য উন্নতি হলে অন্যটির অবনতি ঘটছে; যা কয়েক দিন ধরে নানা মাত্রায় উদ্বেগজনকভাবে ওঠানামা করছে। তবে চিকিৎসকেরা এখনো এই অর্থে আশাবাদী যে তাঁরা খালেদা জিয়াকে যে চিকিৎসা দিচ্ছেন, তিনি তা গ্রহণ করতে পারছেন। ওষুধ কাজ করছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করার পর স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) নিরাপত্তা দেওয়া শুরু করেছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ২-২০ মিনিটের দিকে এসএসএফ সদস্যরা খালেদা জিয়াকে নিরাপত্তা দেওয়া শুরু করেন।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন ও নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান গত রাতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যান।

দেশের একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস হাসপাতালের চিকিৎসক এবং লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের অধীন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে।

জানা গেছে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্য থেকে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল সকালে ঢাকায় পৌঁছেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত এই চিকিৎসকেরা তাঁর শারীরিক অবস্থা দেখার পর পরামর্শ দেবেন। তাঁদের পরামর্শের ওপর নির্ভর করবে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চলবে, না কি লন্ডনে নেওয়া হবে।

এ ছাড়া চীন থেকেও একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের আজ বিকেল নাগাদ ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশটির চিকিৎসকদের পাঁচ সদস্যের একটি অগ্রবর্তী দল ঢাকায় পৌঁছেছে।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দুই দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী খালেদা জিয়ার পরিবার তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে পারে। বিএনপির নেতা ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের অন্যতম এ জেড এম জাহিদ হোসেন গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কাতার, সৌদি আরব, পাকিস্তান ও ভারত খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় ইতিমধ্যে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে।

খালেদা জিয়ার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে গতকাল দুপুরে হাসপাতালের ফটকে জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে ডাক্তাররা যে চিকিৎসা দিচ্ছেন, সেই চিকিৎসা উনি (খালেদা জিয়া) গ্রহণ করতে পারছেন অথবা আমরা যদি বলি উনি মেনটেইন করছেন। যদিও কয়েক দিন ধরে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গুজব চলছে।

অনেকে তাঁর অবস্থা ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ বলে রটাচ্ছেন। তবে যেকোনো ধরনের গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান না দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়ার পরিবার এবং দলের পক্ষ থেকে বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন জাহিদ হোসেন।

বিএনপির এই নেতা বিদেশি চিকিৎসকদের ঢাকায় আসার কথা জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ মুহূর্তে তাঁকে দেশের বাইরে নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।

জাহিদ হোসেন জানান, খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নেওয়ার জন্য দলের সব প্রস্তুতি আছে। রোগীর বর্তমান অবস্থা এবং সর্বোপরি মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শের বাইরে কোনো কিছু করার সুযোগ এই মুহূর্তে তাঁদের হাতে নেই।

খালেদা জিয়াকে দেখতে গিয়ে গতকাল বিএনপির কয়েকজন নেতাকে অশ্রুসিক্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে বের হতে দেখা গেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিন একাধিকবার হাসপাতালে যান। গতকাল বিকেলে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় তাঁকে অশ্রুসিক্ত দেখা যায়। এর আগে দুপুরের দিকে হাসপাতালের ফটকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন। একপর্যায়ে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলেন।

এ ছাড়া খালেদা জিয়াকে দেখতে গতকাল হাসপাতালে যান জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম, গোলাম আকবর খন্দকারসহ মূল বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনায় গতকালও দোয়ার আয়োজন করেছে বিভিন্ন সংগঠন।

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যেও চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। গতকালও অনেক নেতা-কর্মী হাসপাতালের সামনে ভিড় করেছেন। হাসপাতালের সামনের সড়কে প্রিন্ট, অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীদেরও উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। বিএনপি হাসপাতালে ভিড় না করার জন্য নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তবু প্রতিদিনই হাসপাতালের সামনে ভিড় বাড়ছে। সেখানে তাঁরা গণমাধ্যমগুলোতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন।

প্রসঙ্গত গত ২৩ নভেম্বর রাতে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষায় ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ায় তাঁকে ভর্তি করা হয়। গত রবিবার ভোররাতের দিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে এসডিইউ থেকে সিসিইউতে নেওয়া হয়।